অথ ফেমিনিজম কথা…

সতর্কীকরন লেখার ভাষা অতিরিক্ত চাঁচাছোলা, রাখঢাক নেই। ছুৎমার্গ থাকলে, পড়বেন না। আর মনে রাখবেন, লেখক ফেমিনিস্ট নন, কারণ তিনি ফেমিনিজম এর সাধারণ সংজ্ঞাটি সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল নন। তাই তার এই ব্লগ পোষ্টটিকে আবালের বালখিল্যতা মনে করে খ্যামাঘেন্না করে দিলেই খুশি হব। পাঠক/পাঠিকাগন যদি তাতে ক্ষান্ত না হন, তাহলে সারাহা বা পোষ্টটির কমেন্ট সেকশন এ গালিবর্ষন করুন; যতদুর জানি এটা তো এখনো গনতান্ত্রিক(!) দেশ

ঘটনাটার শুরু আজ নয়। অনেক অনেক বছর আগে; মানে এই অগ্নীশ্বর চক্রবর্তীর আগে, নির্ভয়ার আগে, কামদুনির আগে, আর অনেক লক্ষ লক্ষ মেয়ে ধর্ষিতা হওয়ার অনেক অনেক বছর আগে, পুরুষ এবং নারী একে অপরকে আবিস্কার করেছিল। আমাদেরই পূর্বপুরুষ কোন নিয়ান্ডার্থাল বা ক্রোম্যাগনান, শুধুমাত্র যৌনচেতনার বাইরে, অন্য দৃষ্টিতে দেখেছিল বিপরীত লিঙ্গকে, হয়তো জন্ম দিয়েছিল প্রেমের।

আর তারপর, ধাপে ধাপে, সভ্যতা নামক জাঁতাকলটির উন্নতির সাথে সাথে, মানুষ আর একটি জিনিস শিখেছিল, কেড়ে নিতে, বঞ্চিত করতে। আর মানবিকতার অবনমন ঘটেছিল ধাপে ধাপে। ‘সম্পত্তি’র উৎপত্তির সাথে সাথে, যা বাহুবলে রক্ষা করতে হয়, এমন সব জিনিসই হয়ে উঠেছিল সম্পত্তি। আর পুরুষের অজান্তেই হয়তো, তার জীবনসঙ্গিনী নারী, হয়ে উঠেছিল পণ্য, যা রেখে ঢেকে, বাঁচিয়ে না রাখলে, চুরি বা ডাকাতি হওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা ছিল।

আর তাই যুগে যুগে, দেশে দেশে নারীরা পণ্য, ভোগ্যবস্তু, সম্পত্তি, সাম্রাজ্য হয়ে উঠেছে, সে ট্রয়ের হেলেনই হোক, বা চিতোরের রানী পদ্মিনী। আমাদের মহাকাব্যও রেহাই দেয়নি তাদের। পাঁচ ভাইয়ের এক বৌ; ভাবা যায়! স্বামীর প্রতি ‘লয়ালিটি’-এর পরীক্ষা দিতে, এক মহিলাকে আগুনের ওপর দিয়ে হাঁটানো হল, আর রাজার ধর্মের খাতিরে, সেই মহিলার স্বামী সব ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে দেখল। অন্যদিকে ৫ ভাইয়ের এক বৌ হয়েও শান্তি নেই, এক ‘রিগড’ পাশা খেলায়, সেই বৌকে বাজি রাখল পাঁচ ভাই। আর হেরে যাওয়ার পর, সেই কমন বৌয়ের যখন ভরা সভায় কাপড় খুলে নেওয়া হচ্ছে, তখন ও সেই পাঁচ ভাই ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে থাকলেন, কিছু করতে পারলেন না, ধর্মের খাতিরে। ভাগ্য ভালো, হিন্দু পুরাণের ‘সার্টিফায়েড ক্যাসানোভা’ আশেপাশে ছিলেন বলে, সেযাত্রায় ভদ্রমহিলার মান বেঁচে গেল। আরো হাজার হাজার উদাহরন আছে। ইতিহাস থেকে পুরান, ক্লিওপেট্রা থেকে অহল্যা, সকলেই পুরষের কেড়ে খাওয়া স্বভাব আর অনিয়ন্ত্রিত যৌনচাহিদার স্বীকার হয়েছেন, পরে, এমনকি আজও, তাদের দুঃখে চোখের জল ফেলে সবাই বলে/বলেছে; ‘আহা রে!’

এবার একটু ইতিহাসের কথায় আসা যাক। রাজাদের যখন ভরা যৌবন, তখন যুদ্ধটুদ্ধ করবেন, কয়েকটা নিরীহ লোক খামখা মারা যাবে, এ তো জানা কথা, সে আলেকজান্ডার থেকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য, যে-ই হোক না কেন, লোক না মেরে তো আর যুদ্ধ করা যায় না; ওদিকে ছোট ছোট রাজাদের বিপদ। ধরুন, আপনি হলেন সেরকম একটা ছোট রাজ্যের রাজা, সক্কালবেলা ঘুম থেকে উঠে গোলাপজল দিয়ে মুখ ধুয়ে ভাবছেন, ‘এবার প্রাতকৃত্যটা সেরে ফেললেই হয়’ এমন সময় হৈ হৈ কান্ড, রৈ রৈ ব্যাপার। রাজ্যের সীমানায় কোন এক রাজা, আর তার যা সেনাবাহিনী, আপনার পাকা মাথায় অত চুলও নেই। কি করবেন? সাদা ফ্ল্যাগ ওড়াতে, বা একটা কচি ছেলের সামনে হাঁটু গেড়ে বসতে গায়ে লাগে, কিন্তু যুদ্ধে গেলে একেবারে কচুকাটা হয়ে যাবেন। তাই প্রাতকৃত্য মাথায় উঠল, আপনি ছুটলেন সেই কচি রাজার কাছে।

‘বাবা, রাগ কোরো না, তোমার সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দেব…”

ব্যাস! হয়ে গেল! বলেইছি না, সম্পত্তি! আপনার মেয়ে নামক কারেন্সি দিয়ে আপনি কচি রাজার কাছে ইমিউনিটি আর সিকিওরিটি কিনে নিলেন। আর এই কচি রাজার তাই রাজ্যপিছু একটা করে ট্রফি ওয়াইফ প্রাপ্তি হল। ট্রফি ওয়াইফ পিছু একটা করেও বাচ্চা হল ধরুন, মেয়ে হলে কারেন্সি, লায়াবিলিটি, আর ছেলে হলে ভবিষ্যৎ, অ্যাসেট। এবার কচি রাজার আরো কচি ছেলেরা রাজ্য নিয়ে কেটেকুটে মরবে, উলুখগড়ার সাথে সাথে রাজার রাণীদের আর রাজকন্যাদের পিতৃধর্ম, পতিধর্ম পালনের নাম নিয়ে কেনাবেচা হবে, তাদের শরীর নিয়ে দেওয়া হবে হরির লুট। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সেই নারীদের কথা শুনে, বুকভরা কষ্ট নিয়ে বলবে, ‘আহা রে!’।

তারপর হল গিয়ে সার্ব্যজনীন বিধবা পোড়ানোর উৎসব। সতীদাহ নিয়ে কম জলঘোলা হয়েছে? রামমোহন রায় রাজা ছিলেন, তাতেই সাতঘাটের জল খেতে হয়েছিল তাকে। রাজা না হলে আর এস এস এর পূর্বসুরীরা পশ্চাৎদেশে ত্রিশূল গিঁথে, শিককাবাব বানিয়ে ছেড়ে দিত। আসলে, সংস্কার-বিধি-নিয়ম এসব এক থেকে আরেকে জন্ম হয়। বল্লাল সেন চালু করলেন কৌলীন্য; ফলাফল বুড়োর কপালে একটা কচি বউ। বুড়ো মরল সম্পত্তি রেখে, আর রইল কচি বউ। এখন কথা হল, সে সম্পত্তি পাবে কে? পাবে তো সেই কচি বউ! কিন্তু তাহলে বাকি ‘পুরুষ’ সদস্যরা কি আঙ্গুল চুষবে? কভি নেহি! কচি বউকে পুড়িয়ে মারো। শুধু তাই নয়। বিদ্যাসাগর মশাই বিধবা বিবাহ চালু করেছিলেন। তার আগে কি ছিল?

স্বামী মারা গেছে? -সাদা থান পড়ো। মাথাও কামাও। রোজ সকালে উঠে তোমার মনে পড়বে যে তোমার নিজের লোকটি আর নেই। ডিপ্রেশন আসবে পাইকারি দরে।

স্বামী মারা গেছে? -ফুল নিরামিষ খাও। প্রোটিন ইনটেক মিনিমাইজ করো। নাহলে তাড়াতাড়ি মরবে কি করে? পুড়িয়ে মারা মানা যখন, না খাইয়ে মারি।

এরকম হাজার খানা নিয়ম ব্যাখ্যা করে দেখা যেতে পারে যে এন্ড রেজাল্ট একটাই। আমার মত আনকোরা আঁতেলরা এসব কথা ভেবে বলবে, ‘আহা রে!’

072623267895410caa6f25164c9df7c0_18
ছবির ঋণ – আল জাজিরা সংবাদপত্র

তবে এসব হল গিয়ে, পুরাণ আর ইতিহাসের কথা। এই সামান্য ‘আহা রে!’ টুকুও কি কপালে জোটে আমাদের সমাজে একটি মেয়ে, যে কারোর বিকৃত যৌনতার স্বীকার হয়েছে? না! আমরা ৫০০ টাকার টিকিট কেটে, মাল্টিপ্লেক্সের স্ক্রীনে প্রাক্তন পর্ণস্টারের অর্ধউলঙ্গ নৃত্য দেখে অন্তর্বাস ভিজিয়ে ফেলি, আর একজন ধর্ষিতাকে রাস্তায় দেখলে মুখ ঘুরিয়ে নি। কারণ, মেয়েটির শরীর আর পবিত্র নেই। কেন? কারণ কোন এক মানুষরূপী পশু, তার দেহের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে। মেয়েরা আজও অনেক ক্ষেত্রে কারেন্সি না হলেও স্ট্যাটাস সিম্বল তো বটেই। তাই আজও বিয়ের কথা বলার সময় প্রথম প্রশ্ন হয়,

‘আপনারা কি জাত?”

কারণ, ব্রাহ্মণ সন্তান, সে কি আর অজাত কু-জাতে বিয়ে করতে পারে ? উহুঁ।

শুধু ব্রাহ্মণ বলে নয়, সব জাতই তার নিজের আপন জাত্যাভিমানের জাঁতায় পিশে চলেছে অনেক জীবন, সেটা অবশ্য, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। অন্যান্য প্রদেশে, মানে যেখানে এখনো ঢালাও হারে ‘অনার কিলিং’ চলছে, সেসবের কথা না হয় বাদই দিলাম, কারণ সেখানেও ভিক্টিম নারী-পুরুষ উভয়েই।

আমাদের খোদ কলকাতা শহরে বা শহরের কাছেপিঠে এরকম অনেক অনেক পরিবার খুঁজলে পাওয়া যাবে, যেখানে বিধিনিষেধের নামে মধ্যযুগীয় পর্দাপ্রথা চলছে রীতিমত।আর আজ, আমরা একবিংশ শতাব্দীতে বসে তালিবানীরা কিভাবে মেয়েদের মাংসের মত ব্যবহার করছে ভেবে কান্নাকাটি করছি।

নীজেরা কি করছি? সত্যি কথা বলতে, আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই একটা জন্তু বাস করে, যে মায়ের স্নেহে, দিদির আদরে বড় হয়েও, বয়ঃসন্ধিকালের পর থেকে মেয়েদের ভোগ্যপণ্য ভাবতে চায়। সহপাঠিনির ছবি দেখে হস্তমৈথুন করে এসে ‘শিভালরি’ আর ‘ফেমিনিজম’ এর বুলি আওড়ায়। ফেসবুকে একটি মেয়ের ছবিতে কমেন্ট করে ‘নাইস বুবস’। যুগের পর যুগে ধরে, আমরা তো মেয়েদের সম্পত্তি, যৌনযন্ত্র, ভোগ্যবস্তু ছাড়া কিছু ভাবিনি; আমরা ফেমিনিজম বুঝব কি করে?

তাইতো আমরা বলব, ওই মেয়েটার পোশাক খারাপ। ওই মেয়েটার চরিত্র খারাপ। ওই মেয়েটা আমার প্রেম প্রত্যাখ্যান করেছে। তাইত ওকে ধর্ষন করার হুমকি দিয়েছি। আমার কি দোষ? আমার মত ভদ্র ছেলে আর দুটো হয় না। পাড়ায় জিজ্ঞেস করে দেখবেন।

ওই মেয়েটা আমাকে চোখের ইশারা করেছিল। পরে গায়ে হাত দিতে ন্যাকামো শুরু করল। তাইতো রাগের মাথায় রেপ করে ফেলেছি। পুরুষসিংহ তো; রাগলে আর মানুষ থাকি না দাদা! আমার কি দোষ?

তাই দোষ আমার না। কারোর কোনও দোষ নেই। আমার মনে হয় গোটা দেশের সব জেলে, যত কয়েদি আছে, যারা ধর্ষন-শ্লীলতাহানী ইত্যাদির অপরাধে দোষী সাব্যস্ত, তাদের অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া হোক। আর আসল দোষীদের পোড়া হোক জেলে, সিন্দুকে। যারা এখনো আমাদের কাছে শরীর, এখনো আমাদের কাছে কারেন্সি, এখনো ভোগ্যবস্তু, তাদের। তাহলে জেলের গরাদের ওপারে তাকিয়ে আমরা বলতে পারব, আমরা ফেমিনিজম শিখেছি…

শান্তির(?) আশায়

নীল

6 thoughts on “অথ ফেমিনিজম কথা…

  1. ভ্রমরের ডানা

    আসল দোষীদের খুঁজে বের করবে কারা? তারাও তো সমান দোষেই দোষী। ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় কথাটা বোধহয় এই অর্থেই খাটে।
    লেখা আর ভাবনা দুটোই ভালো। তোমার লেখা থেকে একটা জিনিস পরিষ্কার যে যুগে যুগে দেশে দেশে মেয়েদের অবস্থান সেই একই তিমিরে। মেয়েদের তো মানুষ বলেই ভাবা হয় না। তাদের অধিকারের কথা শুনবে কে? জন্মের পর থেকেই তো মেয়েদের মগজ ধোলাই করা হয়- পুরুষের নীচে তোমার স্থান। তাদের সুখেই তোমার সুখ। এমতাবস্থায় ফেমিনিজম কথাটাই বালখিল্যের মতো শোনায়। গোদের উপর আবার বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়ায় ফেমিনাজীরা। চোরাস্রোতে মিশে তারা অধিকারকেও ট্রফি বানাতে চায়।

    Liked by 1 person

  2. Anonymous

    ফেমিনিসম ফেমিনীসম করে করে আসল অর্থ টাই হারিয়ে গেছে। আজকের দিনে ফেমিনিস্ট দের দেখে একটাই জিনিস কেবল মনে একদল স্কন্ধকাটা যারা শুধু নারীর অধিকার বলতে চেলামিল্লি করে পুরুষের সহমত আদায় করার জন্য। যদি এটাই ফেমিনিসম হয় তাহলে অবস্থা কোনোদিন এ পাল্টাবে না। চিরকাল পুরুষের ওপর নির্ভশীল থাকতে হবে।

    Like

Leave a comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.